
১৯৯৫, বাবা এবং আমি
১৯৯৫ সাল। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার সেন্টার পড়েছিলো যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে (পরবর্তীতে এই স্কুল থেকেই SSC পাশ করেছি ২০০১ সালে)। গ্রাম থেকে গিয়ে পরীক্ষা দিতে বাবার সাইকেলে করে গিয়েছি। বাসেও যাওয়া যেতো। কিন্তু সেটা বাবা চান নি কারণ সইকেলের পেছনে পড়াতে পড়াতে নিয়ে যেতেন। বাসে গেলে তো কিছু সময় নষ্ট হবে। সবার সামনে হয়তো পড়ানো যাবে না। স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের সেই স্মৃতিগুলো। বাংলা পরীক্ষার দিন বাবার সাইকেলের পেছনে ক্যারিয়ারে বসেছি। বাবা আমাকে "আমার গ্রাম" রচনার "উপসংহার" মুখস্থ বলতে বললেন। আমি একটা শব্দ বলতে ভুলে গেছিলাম।উল্লেখ্য, আমার বাবার পুরো রচনাই মুখস্ত ছিলো। আমার বেশিরভাগ পড়াই তার মুখস্ত ছিলো। কারণ, বাবা-ই আমার নোট করে দিতেন। বাজারের নোট তেমন পড়া হয় নি। যাই হোক; বাবা তারপর সাইকেলটা পাঁকা রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে আমার গালে চড় কষিয়ে দিলেন। কিন্তু কাঁদি নি। কারণ এরকম মাইর হরহামেশাই খেতাম। ১৯৯৫ সালে আমার ইউনিয়ন থেকে আমি বৃত্তি পেয়েছিলাম। সেসময় একটা ইউনিয়ন থেকে একজন ছেলে,এবং একজন মেয়ে বৃত্তি পেতো। ১৯৯১ থেকে ২০০১ অব্দি কঠোর শাসনে বড় হয়েছিলাম। কোথাও খেলতে যেতে পারি নি তেমন, বেড়াতে যেতে পারি নি। তখন বই পড়া ছিলো আমার প্রধান কাজ। এমনকি ঈদের দিনেও আমাকে পড়ার তাগিদ দেওয়া হতো। বাবা ঐ সময় বলতেন-"যারা পৃথিবীতে বড় হবে; তাদের কোনো বিশেষ দিন নেই। প্রতিটা দিনই শিখতে হবে।" তখন বাবা আবার উদাহরণ দিতেন একজন ছেলের কথা। যিনি আমাদের উপজেলার বোর্ড স্ট্যান্ড করা ছাত্র ছিলেন। উনি ঘুমানো বাদে সবসময় পড়তেন। তার যদি ঘুম আসতো তাহলে চুলের সাথে দড়ি বেঁধে পড়তেন। ঘুম আসলেই যেনো চুলে ব্যথা পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায় ! এরকম অদ্ভূত অদ্ভূত উদাহরণ দিয়ে পড়ার প্রতি আমাকে উৎসাহিত করা হতো। আমার মামীর ভাই; জাকির মামা; যিনি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিলেন সব বোর্ড পরীক্ষায়। তিনি তার বোনের বিয়ের দিনেও বই হাতে নিয়ে ঘুরতেন। এরকম দারুণ দারুণ গল্পের সমাহার সাজাতেন আমার বাবা। বাবা কখনও কখনও সিআইডি এর ভূমিকা পালন করতেন। আমি যেসকল প্রাইভেট স্যারের নিকট পড়তাম, বাবা গোপনে সেই সময়গুলোতে মাঝে মাঝে চুপিসারে সরেজমিনে তদন্ত করতেন। তখন আমার বন্ধুরা হাসতো আর আমার লজ্জা লাগতো। সালটা হবে ২০০০। ক্লাস টেন এ পড়ি। একবার আমি দলবল নিয়ে ক্রিকেট খেলছিলাম। বাবা তদন্ত করতে গিয়ে যখন স্যার এর বাসায় নেই, তখনই বাবা খুঁজতে খুঁজতে ক্রিকেট মাঠে হাজির হয়েছিলেন। যে ছেলেটা ব্যাট করছিলো তার পরের অর্ডারেই আমার ব্যাটিং ছিলো। পাঁকা ১ ঘন্টা ফিল্ডিং করার পরে ব্যাটিং করার মজা অন্তত বাঙ্গালীরা কিংবা যারা ক্রিকেট খেলেন নিয়মিত; তারা ফিলিংসটা বুঝবেন। সেই সময় সবার সামনে আমার হাত টানতে টানতে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিনও পিটিয়েছিলেন। আর আমি তো সেই সময়ে খেলাধূলা করার সুযোগই পাই নি।আমার ফিলিংসটা ছিলো স্বপ্নের মতো। ১/২ মাস পর ১ ঘন্টা খেলতে পারা ছিলো আমার নিকট এভারেস্ট জয়ের মতো আনন্দের। হয়তো সেটা ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য হবে এখন। তারপর আমার বাবা আমাকে শপথ করিয়েছিলেন- আমার এস.এস.সি পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত আমি যেনো ক্রিকেট ব্যাট স্পর্শ না করি ! তারপর স্কুলে সূচনা করলাম লাঠি খেলা। টেপ-টেনিস বল, প্ল্যাস্টিকের বল (টেপ প্যাঁচানো) এগুলোর সাথে লাঠি থাকতো যা ব্যাট এর মতো কাজ করবে। এই লাঠি খেলার টুর্নামেন্টও হতো আমাদের। টিফিনের সময়ে।এখনও নাকি এই ট্রেন্ড আছে আমাদের স্কুলে। অনেকেই হয়তো এই খেলার আবিস্কর্তার নাম এখনও জানে না। শুধু বাবার শপথের কথা ভেবেই এটা শুরু করেছিলাম। কারণ টিফিনের সময় ছিলো আমার মনের খোরাক মেটানোর সময়। সেটাকে হাতছাড়া করি নি স্কুল জীবনের শেষ সময়ে। তারপর এসএসসি পাশ করলাম ২০০১ এ। ইন্টারমিডিয়েট ভর্তি হই যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। কলেজ জীবনের গল্প ছিলো অন্য রকম। কোনো বাঁধা নেই, বিশেষ করে পরিবারের। কলেজ হোস্টেলে শৃঙ্খলতা ছিলো ঠিকই কিন্তু বিনোদনের অভাব ছিলো না।
বাবার ঐ কঠিন শাসন দরকার ছিলো। সেটা আমি সত্যিই উপলব্ধি করতে পারি। বাবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমি এটা জানতাম, আমার বাবার মতো আর দশটা বাবা পাওয়া যায় না সত্যি, যারা শুধু সন্তানদেরকে নিয়েই ভাবে। বাবার জন্য দোআ ছাড়া আর কোনো সম্বল নেই আমার। বাবার সাথে আমার সম্পর্ক এখন বন্ধুর চেয়েও বেশি। মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট তার দীর্ঘায়ু কামনা করি।