ননিতা
ননিতা। বয়স ১৯। অপরূপ সুন্দরী মেয়ে। ৩য় তলায় থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার ভূতত্বে ভর্তি হয়েছে। পড়াশুনায় ব্যস্ত। কোনো অবসর নেই বললেই চলে। কবিতার বই পড়ে ও গান শুনে অবসরটা কাটে। পড়ন্ত বিকালে ছাদে যাওয়াটা ননিতার একটা নেশা। এগুলো জেনেছি ননিতার দাদা মোসলেম উদ্দীন এর কাছ থেকে। ননিতার দাদার সাথে আমার প্রায়ই দেখা হয় মসজিদে। একসাথে ফিরি নামাজ পড়ে। দারুণ একটা মানুষ তিনি। তিনিও খুব বইপোকা একটা মানুষ।রবীন্দ্রনাথ, সমরেশ, সুনীল, শরৎ বাবুর প্রায় সব লেখাগুলোই তিনি পড়েছেন। দারুণ স্মার্ট এবং বুদ্ধিদীপ্ত সুঠামদেহী মানুষ। তিনি ছিলেন ১৯৭১ সালের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মাঝে মাঝেই যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন। আমরা এই অ্যাপার্টমেন্ট এর সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনি এবং একাত্তরের রণাঙ্গনে ফিরে যাই। দারুণ একটা অনুভূতির সঞ্চার হয়।
দাদা কয়েকদিন আগে স্ট্রোক করেন। ননিতা সেদিন সকালে আমাকে ফোন করে তার এই সংবাদ দিয়েছিলো এবং আমাকে দেখা করতে বলে। আমি কিছু ফলমূল নিয়ে ননিতাদের বাসায় যাই; অফিস শেষে। একদম নিথর দেহ পড়ে আছে বিছানায়। আমি যাওয়াতে দাদার ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসি দেখতে পেলাম-
দাদা: অমিও, কেমন আছো দাদু? তোমার কথা আজ খুব মনে হচ্ছিলো। তোমাকে বিরক্ত করলাম না তো?
আমি: দাদু, আমাকে স্মরণ করেছেন, আমি কৃতজ্ঞ। আপনি এখন কেমন আছেন?
দাদা: আলহামদুলিল্লাহ। মসজিদে যেতে পারছি না বলে খুব খারাপ লাগছে। ইমাম সাহেবকে আমার জন্য দোআ করতে বলবে। আমার নাতনী ননিতার সাথে পরিচয় আছে?
আমি: জি, ইমাম সাহেবকে বিশেষভাবে বলবো আপনার কথা এবং দোআ করতে বলবো। ননিতার সাথে আগে সেভাবে পরিচয় হয় নি।
এর মধ্যে কিছু ফলমূল এবং জুস নিয়ে হাজির ননিতা। আগেই বলেছি, অপরূপ দেখতে সে। ভালো কবিতা আবৃত্তিও করে। শুনেছি ভাল গানও গায়। ননিতা আমার কাছাকাছি আসলে; আমার চোখটা নিচের দিকে চলে যায়। আমি সাধারণত কোনো মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারি না। এটা ছোটোবেলা থেকেই। এই বিষয়টা সবাই নোট করতো।
ননিতা: জুস এর গ্লাসটা কি একটু ধরবেন?
আমি: জি…
সেদিন আর কোনো কথাই হয় নি। দাদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এসেছিলাম। পরেরদিন ফজরের নামাজ শেষে ফিরছিলাম বাসায়; তখনই আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে অনেক মানুষের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো। বাসার নিচে আসাতে বুঝতে পারলাম, মোসলেম দাদা আর বেঁচে নেই। মৃত্যুর সংবাদ সবসময়ই কঠিন। পৃথিবীর অন্য সব বাস্তবতাকে যতোটা সহজে মেনে নিতে পারি আমরা, সেই তুলনায় মৃত্যুকে মেনে নিতে পারি না। ননিতা তার দাদার কাছেই মানুষ হয়েছে। ননিতার বাবা যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। ননিতার মা মারা গেলে, ননিতার বাবা একজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মহিলাকে বিয়ে করে সেখানেই সেটেল্ড হয়ে যায়। তারপর থেকে ননিতা তার দাদার কাছেই মানুষ হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে সেটেল্ড হবার আগে, আমাদের অ্যাপার্টমেন্টটি ননিতার নামে লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। বুকের ভিতর একটা চাপা কষ্ট অনুভূত হচ্ছে। দাদাকে খুব মিস করবো। একসাথে নামাজ পড়া, যুদ্ধের গল্প, বই এর রিভিউ নিয়ে আর দাদার সাথে আড্ডা হবে না।
কিছুদিন ধরেই আকাশে নিম্নচাপ। মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে। হালকা বাতাস।
বৃষ্টির দিনে খালি পায়ে রাস্তায় কিংবা ছাদে হাটাহাটি করতে ভাললাগে। বৃষ্টিবিলাস আমার রক্তে। লেখালেখি আমার নেশা।
লিফটের ১০ এ থাকে বন্ধু প্রিতম। আমি থাকি দোতলায়। কয়েকদিন হলো; প্রিতম আমেরিকা থেকে এসেছে। ওর সাথে দেখা করার জন্য লিফটে উঠে দেখি- ননিতা। ও ছাদে যাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর ফাঁকে ভুলেই গিয়েছি যে; আমি লিফটের কোনো বাটন চাপি নি। ননিতা চেয়ে ছিলো আমার দিকে। সে চাহনিতে একটা মায়া ছিলো। নীল রং এর জামা আর নীল রং এর টিপে মোহনীয় লাগছিলো। কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম। ভুলেই গিয়েছি ইতোমধ্যে যে প্রিতমের বাসায় যাচ্ছিলাম ।
ছাদে চলে এসেছি দুজনেই। আবহাওয়া বেশ খারাপ। মনে হচ্ছে কয়েক মিনিটের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হবে। মাঝেমধ্যে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। দমকা হাওয়া বইছে। বৃষ্টির অপেক্ষায় মনটা ছটফট করছিলো। বৃষ্টিও এলো কয়েক মিনিটের মধ্যেই। তুমুল বৃষ্টি। ছাদের উপর কনক্রিটের ছাতা আছে। সেখানে আশ্রয় নিলো ননিতা। আর আমি বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। সাদা পাঞ্জাবী আমার শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে।বৃষ্টির সাথে আমার সখ্যতা বেশ প্রবল। আষাঢ়ে বৃষ্টির ফোঁটার সাথে প্রতিনিয়ত সাক্ষাত হয় আমার।ছাদে শুয়ে পড়েছি এর মধ্যে। চোখ বন্ধ করে আছি আকাশের দিকে মুখ করে। গভীর বৃষ্টিবিলাসে ছেয়ে গেছে সমস্ত শরীর। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি চোখের পাতার উপর পড়ছে। অদ্ভূত ভাললাগায় ডুবে গেছি। হঠাৎ চোখের উপর কারও হাত। তবুও চোখ খুলি নি। তারপর কান্নার শব্দে চোখ খুলেই দেখি ননিতা। ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ততক্ষণে বুঝলাম যে ও ভয় পেয়েছে।
আমি: তুমি কাঁদছো কেনো?
ননিতা: ভয় পেয়েছিলাম আপনাকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে।
আমি: ধুর পাগলী, তাই বলে এভাবে কাঁদতে হবে?
ননিতা: আপনি একটা পাগল। এভাবে কেউ বৃষ্টির মধ্যে শুয়ে থাকে?
আমি: আমি অন্য সবার মতো না। আমি কেবল আমিই।
ননিতা: আপনি একটা পাগল
আমি: ঠিক বলেছো। এখনও তুমি কাঁপছো কেনো?
ননিতা: আপনি কি আমার হাতটা একটু ছুঁয়ে দেবেন?
আমি তার হাত ধরেই বললাম: তুমি এতো সুন্দর কেনো?
সেদিন কিভাবে ফিরেছিলাম বাসায়; তা আর মনে নেই। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সেদিন রাতে ননিতার বাসায় ইন্টারকমে ফোন দিয়ে জেনেছিলাম; ননিতার প্রচন্ড জ্বর। ১০৪ ডিগ্রী। ও নাকি তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
এরপর বেশ কয়েকটা দিন জ্বরে ভুগে ভুগে গতকাল রাতে ননিতার আকস্মিক মৃত্যুর খবর পেলাম। এখনও ভাবতে পারছি না যে ননিতা আর নেই। কোন অভিমানে চলে গেলো সেই সমীকরণের হিসাব মেলাতে পারছি না। এখন মনে হচ্ছে-সেদিনের সেই বৃষ্টিই হয়তো ওর জীবনে কালো অন্ধকার নিয়ে এলো। ও হয়তো আজকেও ছাদে আসতো। নিজের জন্যও খারাপ লাগছে যে-হয়তো কোনোদিনই বৃষ্টিতে ভেজা হবে না আর। ননিতার সাথে সাথে আমার বৃষ্টিবিলাসকেও আজ থেকে হয়তো জলাঞ্জলী দিলাম। কিছু সুখময় স্মৃতি নিয়ে বাকি জীবনটা হয়তো কেটে যাবে। ওর জীবনের স্বপ্নগুলো কি ছিলো জানতে পারলে ভালো হতো। হয়তো কিছু পূরণে চেষ্টা করা যেতো। ওর জন্য খুব মায়া লাগে। এই মায়া আছে বলেই হয়তো জীবনের যে স্বাদ আছে সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। সহজেই যদি জীবনটা পার হয়ে যেতো; তাহলে হয়তো জীবনে বেঁচে থাকার অর্থটা উপলব্ধি করতে পারতাম না।
মাঝে মাঝে ঘোরের মধ্যে ডুবে যাই। অনেকটাই আমার লেখার মতো…..
যাই হোক; ননিতা; তোমার জন্য আমার বাকি জীবনের অতৃপ্ত বৃষ্টিবিলাসকে উৎসর্গ করলাম। ভালো থেকো।