কেমন হবে করোনা পরবর্তী আগামী বিশ্ব?
২০১৯ এর শেষ দিনটা; অর্থাৎ থার্টি ফার্স্ট নাইটে মনে মনে ২০২০ এর রেজুলেশন অনেকেই ভেবেছিলেন বা কোথাও হয়তো লিখে রেখেছিলেন আবার কেউ কেউ হয়তো স্ট্যটাসও দিয়েছিলেন। কেউ হয়তো ভেবেছিলেন ২০১৯ পর্যন্ত যার কাছে যতো ঋণ আছে, সেটা ২০২০ এ এসে শোধ করে দিবেন, কেউ হয়তো বাড়ির কাজে হাত দিবেন, কেউ হয়তো সেভিংস এ মনোযোগী হতে চেয়েছিলেন, কেউ হয়তো বাড়িতে নতুন বউ আনতে চেয়েছিলেন, কেউ হয়তো কয়েকটা দেশে ভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন, তাই না? ভাগ্যবিধাতা সেটা কিন্তু বেশিরভাগই হতে দেন নি। ফিউচারোলজিস্ট বা ভবিষ্যতদ্রষ্টাদের এবারের ২০২০ এর সব কিছুই উল্টাপাল্টা করে দিয়েছে এই করোনাভাইরাস। বিশ্ববাসী আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। সারা বিশ্বের অর্থনীতি থমকে গেছে। এবার আসল কথায় আসি—করোনা পরবর্তী কেমন বিশ্বকে আমরা দেখতে পারি?
১. আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলেজেন্স(AI) বা রোবটের ব্যবহার
সারা বিশ্বে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলেজেন্স(AI) বা রোবটের কদর বেড়ে যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ৫ বছরের মধ্যে শ্রমবাজারের অর্ধেক চলে যাবে রোবটের দখলে। অদূর ভবিষ্যতে আর ট্যাক্সি ভাড়া করতে হবে না, কিংবা বাস, ট্রাক চালাতে চালকের প্রয়োজন হবে না। রেস্টুরেন্ট-শপিং মলে মানুষকে স্বাগত জানাচ্ছে রোবট, চিকিৎসাক্ষেত্রে রোবটিক সার্জারির অগ্রগতি এবং ক্যান্সার শনাক্তকরণ ও হার্টের পরিস্থিতি বুঝতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার।
রোবট চাকরির ইন্টারভিউ নেবে। যদিও সুইডেনের বড় বড় রিক্রুট এজেন্সিতে অনেক আগে থেকেই রোবটের ব্যবহার শুরু হয়েছে। তবে সারা বিশ্বে এর ব্যাপকতা বেড়ে যাবে। রেস্টুরেন্টগুলোতে র্যানডমলি দেখা যাবে। বিশ্বের অনেক মানুষ বেকার হবে। সেটা করোনার মতো দুর্যোগ মোকাবেলা করেও অর্থনীতির জন্য হয়তো আশির্বাদ হবে। ভবিষ্যতে করোনার মতো দুর্যোগে যেন কোনো শিল্প কলকারখানা বন্ধ না হয়ে যায়, এজন্য প্রডাকশনের অধিকাংশ কাজ চলে যাবে রোবটের দখলে। একমাত্র সৃজনশীলতা ছাড়া সব ক্ষেত্রেই রোবট মানুষকে হারাবে।
২. অনলাইনে শিক্ষা কার্য্যক্রম
অনলাইনে শিক্ষা কার্য্যক্রম বেশ আগে থেকেই শুরু হয়েছে সারা বিশ্বে। করোনা পরবর্তী সময়ে অনেক অনেক ডিগ্রী অর্জনকরা যাবে অনলাইনে। বাংলাদেশে করোনার মধ্যে বেশ কিছু অনলাইন শিক্ষা কার্য্যক্রমগুলো সবার নজরে এসেছে এবং এর অনুশীলন শুরু হয়েছে। হয়তো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যারদের লেকচার শুনতে আর ক্লাসে যেতে হবে না।বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এরিয়া ছোটো হয়ে যেতে পারে আগামীতে। হাজার হাজার একর নিয়ে গড়া বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো আমরা আর দেখতে পারবো না। স্যারেরা লাইভ ক্লাস নিবেন, পরীক্ষাও হবে অনলাইনে, যাবতীয় সবকিছুই অনলাইনে সম্পন্ন হবে। শুধু হয়তো, সমাবর্তন একটা অনুষ্ঠান করে রাষ্ট্রপতির নিকট থেকে হার্ড কপি সার্টিফিকেট নেওয়া হবে। বিষয়টা ভাবুনতো একবার? যেতে হবে না আর ক্লাসে, সময়মতো স্যারের লেকচারও হয়তো নেটে পাওয়া যাবে একটি নির্দিষ্ট সার্ভারে। সেখান থেকে প্রয়োজনমতো ডাউনলোড করে নেওয়া যাবে।
৩. ভার্চুয়াল অফিস
অফিসের কাজও হবে অনলাইনে। ৯টা-৫টা অফিস করতে হবে না। প্রজেক্ট ডেডলাইন অনুযায়ী কাজ সাবমিট করলেই হয়ে যাবে।ইচ্ছামতো পরিবারকে সময় দিবেন আবার নিজ উদ্যোগে কাজও সেরে ফেলতে হবে। ফাঁকি দেবার সুযোগও থাকবে না। মনিটরিংও হবে অনলাইনে। বড় বড় অফিস আর নিতে হবে না কোম্পানীগুলোকে। মিটিং হবে অনলাইনে। বিদেশে মিটিং এ অংশ নিতে আর ফরমালিটি করতে হবে না। এইসব ফরমালিটি হবে অনলাইনে। শুধু মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা কাজ করবে অফলাইনে। বাকি সব কাজ শেষ হবে অনলাইনে।
৪. স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক পরিবর্তন
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বেশিরভাগই হয়তো হবে টেলিসেবা বা লাইভে। স্বাস্থ্য সেবার অনেক কিছুই রোবট নির্ধারণ করে দিবে। টেস্ট থেকে শুরু করে রিপোর্ট প্রদান পর্যন্ত। স্বাস্থ্যখানে “জেনেটিক মোডিফিকেশন” হবে চোখে পড়ার মতো।সহজ ভাষায় বললে, ‘ক্রিসপার কেস-৯’ নামক অত্যাধুনিক জিনোম সম্পাদনার টুল দ্বারা মানুষের জিনে লক্ষণীয় পরিবর্তন সাধনই হচ্ছে জেনেটিক মডিফিকেশন। একে অনেকসময় ‘জিন এডিটিং’ বা জিন সম্পাদনাও বলা হয়। অনেক অনৈতিক কাজও বেড়ে যাবে এই সম্পাদনার ক্ষেত্রে। আমরা যেমন ফটোশপে ছবি এডিট করে সমাজে বিশৃঙ্খলা করি, ঠিক তেমনি এই জেনেটিক সম্পাদনার ক্ষেত্রে সাইবার ক্রাইম, জেনেটিক ক্রাইমও বেড়ে যাবে। বিশ্ব কিভাবে এটাকে শাসন করে তার উপর নির্ভর করবে। ব্রেইন বুস্টার এর আধিক্য ও প্রয়োগ বেড়ে যাবে যা ক্ষেত্রবিশেষে সমস্যা সৃষ্টি করবে। ধীরে ধীরে মানুষের গড় আয়ু বাড়বে। এখনই সুইজারল্যান্ডে গড় আয়ু ৮০ বছর। আগামীতে পুরো বিশ্বে গড় আয়ু ধীরে ধীরে বাড়বে। কারণ আগামীতে জীন সম্পাদনার জন্য ক্যান্সারের মতো রোগ হবে না ১০০ বছর বয়সী মানুষদের। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে করমর্দন বা কোলাকুলি রীতি উঠে যাবার সম্ভাবনা আছে।
৫. ভবিষ্যতের ব্যবসা
এবার আসা যাক ব্যবসার ক্ষেত্রে। ব্যবসার ধরণগুলো যাবে পাল্টে। অনেক অফলাইন ব্যবসা চিরতরে মুছে যাবে। অনলাইন/ই-কমার্স এর প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। নতুন নতুন টেকনোলজি আসবে ই-কমার্সে। ডেলিভ্যারিম্যান হিসাবে মানুষ আর দেখা যাবে না হয়তো। সর্বক্ষেত্রে ড্রোন দিয়ে ডেলিভারির কাজ চলবে। ৫০%-৭৫% মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে অনলাইনে। সবার সার্ভিস দেখা যাবে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। কৃষি উদ্যোগগুলো ব্যাপকভাবে দেখা যাবে। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যাবে বেড়ে। যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় যারা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, কেবল তারাই টিকে থাকে স্বগর্বে। সেটা গাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বিশ্ববাসী। এই করোনা দুর্যোগ কেটে গেলে কৃষি উদ্যোগের প্রতি মানুষের চাহিদা বাড়বে। খাদ্য নিরাপত্তায় মানুষ বেশ মনোযোগী হবে। ক্ল্যায়েন্ট মিটিংগুলো হবে অনলাইনে। সুতরাং কনভেনশন সিটি ভাড়া করে অনুষ্ঠান করা কমে যাবে। প্রডাক্ট শোকেসিংও হবে অনলাইনে। অনলাইন মেলা হবে। মেলা উপলক্ষ্যে ছাড়ও হবে অনলাইনে। ট্যুরস এন্ড ট্রাভেল ব্যবসা খারাপের দিকে যেতে পারে। পর্যটন শিল্প হুমকির মুখে পড়তে পারে। যারা শুধু ব্যভসার সাথে টেকনোলজির উত্তম ব্যবহার করতে পারবে; তারাই টিকে থাকবে আগামী বিশ্বে।
কনটেন্ট কপিরাইট: হাদিউজ্জামান পলক, সিইও, মনোপুতো