আরশি

৫ বছর আগের কথা। ৬ মে, ২০১৫। নাটোরে বন্ধু রূপকথার বিয়েতে যোগ দিতে হবে। যেদিন বিয়ে তার আগের দিন; অর্থাৎ ৫ মে রূপকথার ফোনটা যখন পাই, তখন আমি কলকাতার ইলিয়ট পার্কের পাশে টাটা সেন্টারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ। হোয়াটসঅ্যাপ এ বন্ধুর কল পেয়ে চমকে গিয়েছিলাম। বন্ধুটার অনেকদিন ধরেই বিয়েটা আটকে গিয়েছিলো। কাছের সব বন্ধুদের বিয়ে হলেও কোনো একটি অজানা কারণে বিয়ে হচ্ছিলো না। যদিও রূপকথার গ্রামের মানুষেরা বলছিলো কেউ নাকি বন্ধূকে তাবিজ করেছে। এজন্য বিয়ের শেষ পর্যায়ে গিয়ে আর সফল হয় না। এর আগেও একবার ওর বিয়ের প্রগ্রামে গিয়েছিলাম। সেই বিয়েতে বড় বড় ৩ টি গরু জবাই হয়েছিলো, ১০ টি খাসি জবাই হয়েছিলো, বিশাল আয়োজন করেছিলো রূপকথার বাবা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রূপকথার হবু শ্বশুর হার্ট এটাকে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এজন্য ঐ বিয়েটা আর হয় নি। সেদিনের রূপকথার সেই চোখের পানি আজও আমার হৃদয়ে মোচড় দেয়। কষ্ট দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় এর আরও কয়েকজন ব্যাচমেট সেই সময় রূপকথার সাথেই ছিলাম, ওর দু:সময়ে। সেই দিনটা আজ বড্ড মনে পড়ছে। দেশে ফেরার কথা ছিলো ১৪ মে, ২০১৫। হঠাৎ, রূপকথার ফোনটা পুরো শিডিউল পরিবর্তন করেছিলো। টানা কিছু মিটিং ক্যানসেল করে ময়দান থেকে দমদম মেট্রোতে ফিরেছি ৫ মে সন্ধ্যায়। ১৪ তারিখেরে ফ্লাইট ক্যানসেল করেছি অনলাইনে। ঐদিনই সন্ধ্যায় দমদম এয়ারপোর্ট গিয়ে টিকেট কেটে ঢাকা এয়ারপোর্টে ফিরেছি রাতেই। ঢাকা থেকে রাজশাহী বিমানের টিকেট পাই নি সেই রাতে। বাধ্য হয়ে রাত ১১ টার পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেন এর টিকেট কনফর্ম করেছিলাম। বিমানবন্দর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঠিক রাত ১১ টায় ট্রেন চলে এসেছিলো। আমি আমার বগিতে বসতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার সিট এর পাশ দিয়ে দৌড়াচ্ছিলো শাড়ী পরিহিত অল্প বয়োসী নারী। বয়স হবে ২৬-২৭ এর মধ্যে।সাথে ছিলো তার স্বামী। তার বয়স হবে আনুমানিক ৪৫-৪৭ এর মধ্যে। দুজনের বয়সের পার্থক্যটা বেশ চোখে লাগছিলো। ট্রেনটা হালকা করে ছেড়ে দিয়েছে ততক্ষণে। স্বামীটা তার পিছন পিছন দৌড়াচ্ছিলো। আমি আমার বগির দরজার সামনে ছুটে গিয়েছিলাম। হাতটা বাড়িয়ে দিতেই সে সজোরে আমার হাতটা চেপে ধরে কোনো মতে উঠে গিয়েছিলো। বিপত্তি ঘটেছিলো তার স্বামীর বেলায়। শেষ পর্যন্ত সে উঠতে পারে নি। তার আগেই ট্রেনটার গতিও বেড়ে গিয়েছিলো। তার স্বামী যদি তাৎক্ষণিক রিস্ক নিতো ট্রেনে উঠবার, তাহলে বড় ধরণের দুর্ঘটনাও হতে পারতো। যাই হোক, সেটা তখন হয় নি। দুজনেই হাফিয়ে উঠেছি। অপরিচিতার চোখে মুখে কোনো সংশয় দেখতে পাই নি। শ্যাম বর্ণের মেয়েরা সাধারণত অপরূপা হয়। কিন্তু আমি যাকে দেখছিলাম, সে যেনো অন্য গ্রহের অপরূপা সুন্দরী। সৃষ্টিকর্তা যেনো তাকে বিশেষ যত্নে গড়েছেন। কোথাও একটুও খাঁদ নেই। সৃষ্টিকর্তার কোনো সৃষ্টিতেই কোনো অযত্ন, অবহেলা নেই, সেটা জানি। কিন্তু এই অপরিচিতাকে দেখে মনে হয়েছে বিশেষ কোনো কারণে হয়তো তাকে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে। একটা সোনালী পেড়ে গোলাপী শাড়ী, হালকা মেক-আপ, চোখে কাজল, ঠোঁটের নিচে ছোট্টো কালো তিল, কপালে কালো টিপ। কোথায় যেনো হারিয়ে গিয়েছিলাম। সিনেমার মতো। তবে বাস্তবে যে তখনও হাতটা ধরে ছিলাম, খেয়াল করি নি।

অপরিচিতা: এখন হাতটা ছেড়ে দিতে পারেন। আমরা সিটে এসে বসেছি কিছুক্ষণ আগেই।
আমি: ঘোর কাটিয়ে কিছু হয় নি এমনভাবে বললাম, আমি নীল।
অপরিচিতা: আরশি
আমি: আপনার কি ভয় লাগছে? স্বামীকে ঐ ভাবে ফেলে রেখে এসে কি মন খারাপ লাগছে?
আরশি: না না, ঠিক আছে।
আমি: কোথায় যাচ্ছেন?
আরশি: স্বামীর কাজে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সেমিনারে অংশ নিতে।
আমি: কোথায় থাকবেন?
আরশি: আইবিএস এ একটি গেস্ট হাউজে থাকার কথা।

আরশির গোলাপী পার্টস থেকে ফোনটা বেজে উঠলো।
আরশি: তুমি চিন্তা করো না। সকালের ফ্লাইটে চলে এসো। আমি ঠিক আছি।

এরপর খাবারের ব্যাগ থেকে বের হয়ে আসলো খাবারসামগ্রী। কলকাতা এয়ারপোর্টে স্ন্যাকস খেয়েছিলাম। রাতের খাবার খাওয়ার সুযোগ পাই নি। খাবার বের করতে করতে আরশি প্রশ্ন করলো--
আরশি: বাসায় কে কে আছেন?
আমি: একাই থাকি। স্ত্রী শ্রীমঙ্গলে থাকে। চায়ের দেশে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। বউ এর কাছে আমি অতিথি। মাঝে মাঝে বউ এর নিমন্ত্রণে চা খেতে যাই।
আরশি: বাহ ! সুইট তো ! বাচ্চা-কাচ্চা আছে?
আমি: নাহ ! কিচিরমিচির শব্দ শোনার সৌভাগ্য হয় নি। :)
আরশি: আপনি কি করেন?
আমি: কয়েকটি দেশে ব্যবসা আছে। হেড কোয়ার্টার সুইজারল্যান্ডে। দেশে বেশিরভাগ সময়ই থাকি না। ঘুরে ঘুরে বেড়াই। পাখীর মতো।

আরশি একটি প্লেট ধরিয়ে দিলো। বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে এসেছে। আলু ভর্তা, লাউ-চিংড়ি, সাদা ভাত। তার চোখে মুখে যেনো একটা প্রশান্তির চিহ্ন। আমি অবাক হচ্ছি, তার মধ্যে একটুও সংশয় নেই। মনে হচ্ছে, আমি যেনো তার খুবই আপনজন। যাই হোক, কেনো যেনো আমিও মিশে গিয়েছিলাম। দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্তির ছাপও ছিলো না আমার মধ্যে। তাছাড়া ক্ষুধার্তও ছিলাম। নির্লজ্জের মতো হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে খাওয়া শুরু করে দিয়েছিলাম। আলু ভর্তা আমার খুবই প্রিয় খাবারের মধ্যে। এর মধ্যে বিশেষত্ব কিছু না থাকলেও কেনো যেনো এই খাবারটির মধ্যে এক ধরণের ভালবাসা পাই। তার মধ্যে আবার আমের আচার দিয়েছিলো আরশি। গত কয়েকদিনে হোটেলের খাবার খেয়ে খেয়ে এই খাবারটি ছিলো অমৃত। খাবার শেষে আবার ব্যাগ থেকে আরশি চা বের করে দিলো। কেমন যেনো সবকিছুই একটা চাওয়ার আগেই পাওয়ার মতো ছিলো বিষয়টা। ট্রেনে বসে জানালার মৃদু হাওয়ায় দুধ চায়ে মুখ দেওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। ট্রেনের আলো নিভে গেলো। কিছুক্ষণ পর ট্রেনটি টাঙ্গাইল স্টেশনে থেমে গেলো। আরশি ব্যাগ এ কি যেনো একটা খুঁজছিলো ! মনটা খারাপ দেখাচ্ছিলো ক্ষণিকের মধ্যেই।

আরশি: খুব মেজাজ খারাপ লাগছে। চকলেটের প্যাকেট মনে হয় আমার স্বামী তার ব্যাগে রেখে দিয়েছে। আমার তো এখন চকলেট খেতে ইচ্ছা করছে।
আমি: কলকাতা থেকে কিছু চকলেট এনেছি। ভেবেছিলাম, আপনাকে পরে দিবো। এগুলো নিয়ে ধন্য করেন।
আরশি: না, না। আপনি হয়তো আপনার প্রিয়জনের জন্য এনেছেন। সিরিয়াস হবার দরকার নেই।
আমি: তাহলে আলু ভর্তা খেয়ে কি কোনো ভুল করেছি?

সঙ্গে সঙ্গে ছো মেরে চকলেট বক্সটি নিয়ে নিলো আরশি। সেগুলো তখনই শেষ করে ফেলেছিলো। একটা মেয়ের চকলেট কতোটা প্রিয় হতে পারে; তা আরশিকে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। খেতে খেতে তার অবস্থাটা এমন হয়েছিলো যে তার ঠোঁটের নিচের তিলটাও ঢেঁকে গিয়েছিলো। এরপরই ট্রেন এর লাইট বন্ধ হয়ে গেলো। দুজনে দুই জানালায় বসেছি। একে অপরের বীপরীত পার্শ্বে। জানালা দিয়ে পূর্ণিমার আলো আরশির মুখে পড়ছিলো। একসময় সে ঘুমিয়ে যায়। ঘুমালে আরশিকে অদ্ভূত সুন্দর লাগে। ডান পাশে কাত হয়ে জানালার দিকে শুয়ে ছিলো। আমি শুধু অপলক চোখে তাকিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে গাছের সারির আবডালে চাঁদটা ঢেকে যাচ্ছিলো। তখন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিলো। যখন ট্রেনটা মাঠের মধ্যে দিয়ে যায়, তখন সেই মায়াবী মুখটা দেখা যায়। বারবার মনে হচ্ছিলো, ট্রেনের পুরোটা রাস্তা যদি মাঠের মধ্যেই হতো, তাহলে এই মুখটা দেখতে দেখতে বাকিটা পথ নির্ঘুম কাটিয়ে দেওয়া যেতো। হঠাৎ, নিজেকে প্রশ্ন করছি, "আমি কি প্রেমে পড়ছি না কি? আরশির মুখ নিয়েই বা এতো গবেষণার কি আছে?" একসময় ট্রেনটা নাটোরের আব্দুলপুর স্টেশনে থামলো। ভোর ৪ টা ৩৫ মিনিট। এখানেই নামতে হবে। ট্রেনটা থামতেই আরশির ঘুম ভেঙ্গে গেলো।