একজন তৃষ্ণার গল্প
আদিত্য ছিলো আমাদের অফিসের সবচেয়ে আকর্ষনীয় সহকর্মী। বয়স ৩৫। তখনও বিয়ে করে নি। হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গোলাপী ঠোঁট, ভ্রমরকালো ভ্রুযুগল, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, স্লিম, টিয়াপাখীর মতো নাক এবং লম্বা দেহে গড়া একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ। অসম্ভব মিষ্ট ভাষায় সে কথা বলতে পারতো। স্বামীর সাথে আমার ডিভোর্স হওয়ার পর অনেক পুরুষ আমার কাছে আসতে চেয়েছে। অফিসের বস, সহকর্মী, প্রতিবেশী, স্বামীর বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ। সবাই হয়তো আমার দেহটাকে নিয়ে খেলতে চেয়েছে। কেউই আমার দায়িত্ব নিতে চায় নি। ডিভোর্সের ৩ বছরে যে জিনিসটি মনে হয়েছিলো- অনেকেই ভালোবাসতে চায়, সঙ্গ দিতে চায়, লং ড্রাইভে গিয়ে ফুর্তি করতে চায় কিন্তু মন থেকে সব কিছু মেনে নিয়ে গ্রহণ করার মতো মানুষ এই সমাজে কমই আছে। কিন্তু এই আদিত্যকে আমার অসম্ভব ভালো লাগতে শুরু করেছিলো। কয়েকটি উদাহরণ দিই। আগামীকাল কোন রং এর পোষাক পরে আদিত্য অফিসে আসবে সেটা জেনে পরের দিন ঐ রং এর একটা ড্রেস/শাড়ী পরে অফিসে যেতাম। প্রায়ই বলতাম, “আপনাকে আজ সুন্দর ও আকর্ষনীয় লাগছে”। “আমি আজ খাবার নিয়ে আসি নি, আমার সাথে বাইরে খাবেন?” এই ধরণের অনেক কিছুই ঘটতো যা ছিলো ভালোলাগারই বহি:প্রকাশ। এর কিছুদিন পর আমাকে চমকে দেয় আদিত্য।
আদিত্য: আচ্ছা তৃষ্ণা, কাল কি আপনার সময় হবে?
আমি: আমার সময়ের অভাব নেই। কখন কোথায় যেতে হবে, বলুন।
আদিত্য: অফিস শেষ করে বলবো।
আমি: আচ্ছা ঠিক আছে।
পরের দিন নীল একটি শাড়ী পরে অফিসে গিয়েছি। অফিসে গিয়ে দেখি আদিত্যও নীল একটি শার্ট, কালো রং এর জিন্স পরে অফিসে এসেছে। বলে রাখি; ঐ দিন আমার জন্মদিন ছিলো যা অফিসের কেউই জানতো না। ইচ্ছা করেই বলি নি। সেদিন বিকাল ৫ টায় অফিস শেষে দুজনে বের হলাম একসাথে।
আদিত্য: গাড়িতে উঠুন
আমি: কোথায় যাবো আমরা?
আদিত্য: (মৃদু হেসে) কাশবনে, আপত্তি আছে?
আমি: নেই। চলুন।
গাড়ীতে উঠেই বেজে উঠলো-“ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে”।
আমার অসম্ভব প্রিয় একটি গান। হারিয়ে গিয়েছিলাম মুহূর্তের মধ্যেই।
গাড়ী থামলো ৩০০ ফুট রাস্তার পাশে ছোট্টো একটি রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্ট এর ভেতরটা অন্ধকার। হঠাৎ একটু ভয় লাগলো।
প্রবেশ করতেই দেখি পুরো রেস্টুরেন্ট আলোকিত হয়ে গেলো।
আমার চোখে মুখে উচ্ছ্বাসের ঝলকানি। এতো আনন্দিত জীবনে অনুভব করি নি। এতোটা অবাক করার ঘটনা আগে ঘটে নি আমার জীবনে। আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছা করছিলো সত্যি। কিন্তু সেই আবেগ জলাঞ্জলি দিয়ে স্বাভাবিক হাসি দিয়ে চেয়ারটা টেনে বসেছিলাম। সাথে সাথেই আমার ২৮ তম জন্মদিনের কেকটা চলে আসলো। আমি অবাক হচ্ছিলাম এই আয়োজন দেখে। আমি ভেবেই নিয়েছিলাম জন্মদিনের কথাটা কোনোভাবেই আদিত্য জানে না। সব কিছুই স্বপ্ন মনে হচ্ছিলো; যা দিবালকের মতোই পরিস্কার ছিলো। গত ৩ বছরের বুকের ভেতরের জমানো কষ্ট আর অনুভূতিগুলো জন্মদিনের মোমবাতি নেভানোর সাথে সাথেই কেমন যেনো নিভে গিয়েছিলো। এক ধরণের চাপা উত্তেজনায় ছটফট করছিলাম। সেদিনের ঐ আয়োজনের পরে আমাকে আমার বাসায় দিয়ে আদিত্য তার বাসায় ফিরেছিলো। আরও কিছুদিন গেলো। হঠাৎ আদিত্য অফিসে আসা বন্ধ করে দিলো। ২ দিন পার হওয়াতে আমার মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করছিলো। ফোনেও পাচ্ছিলাম না। ওর বাসার ঠিকানাও জানি না। শুধু জানতাম, গুলশান এর লেকের পাড়েই ওর বাসা। একা থাকে। দিনটা ছিলো বৃহস্পতিবার। অফিসের এইচআর ডিপার্টমেন্ট থেকে ওর সিভিটা বের করে বর্তমান ঠিকানাটা সংগ্রহ করেছিলাম। ঐ সময়েই সিদ্ধান্ত নিলাম যে আদিত্যের বাসায় যাবো। অফিস থেকে বের হয়ে তার বাসায় যেতে যেতে বেজে গেলো রাত ৯ টা। কলিং বেল চাপতেই আদিত্য দরজা খুলে দিলো। ভেতরে গেলাম। বুঝলাম আদিত্যের বেশ জ্বর। ঘরটা অগোছালো থাকাতে একটু অস্বস্থিতে পড়েছিলো আদিত্য। সেটা সামলে নিয়ে তার দিকে তাকিয়েছিলাম আর দেখেছিলাম একাকীত্বের ছাপ। তার দৃষ্টিতে ছিলো ভালোবাসার আকুতি। তীব্র কাছে পাওয়ার একটা বাসনা ছিলো তার চোখে-মুখে।
আমি: অাচ্ছা, আমাকে ফোন করেন নি কেনো? আপনার এতো জ্বর, একা সামলাবেন কিভাবে সবকিছু?
আদিত্য: পারছি তো। একা থাকতেই তো ভালো লাগে। এভাবেই যাক না !
আমি: এটা কোনো জীবন হলো? সঙ্গী ছাড়া জীবন চলে?
আদিত্য: দিব্যি চলে যাচ্ছে আমার। টেনশন নেই। খাওয়া-দাওয়ারও ঠিক নেই যদিও; তবুও ভালো আছি।
আমি: বিয়ে করবেন না? আপনার এই একাকীত্ব আমার মোটেই ভালো লাগছে না।
আদিত্য: এই ছন্নছাড়া জীবনে কাউকে সঙ্গী করে তাকে কষ্ট দিতে চাই না। এই বেশ ভালো আছি।
আমি: কষ্টবিলাসিতা আপনাকে মানায় না। আপনি কাউকে বিয়ে করুন।
আদিত্য: আমাকে বিয়ে করবেন?
এই কথা বলেই আদিত্য আমার হাত চেপে ধরেছিলো। হাতটা সরিয়ে দিয়েছিলাম এবং দূরে সরে যেতে চাইলে আমাকে জড়িয়ে ধরে। একটা অপরাধবোধ কাজ করে ক্ষণিকের জন্য। পরে অবশ্য নিজেকে ধরে রাখতে পারি নি আমিও। সপে দিয়েছিলাম নিজেকে। মেলে ধরেছিলাম নিজের মতো করে। বিগত দিনের কষ্টগুলো আদিত্যের বুকের মধ্যে চাপা পড়ে গিয়েছিলো। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বেজে গেলো। বাসায় ফিরে আমার বুকের ছটফটানি আর কে দেখে ! হৃদয়ের ভেতরের বইয়ে যাওয়া অনুভূতিগুলো আমাকে সেদিন রাতে ঘুমোতে দেয় নি। আরও কিছুদিন গেলো। আদিত্যটে পালটে যেতে দেখলাম একটু একটু করে। ওর আচরণগুলো পাল্টে গেলো। হঠাৎ আদিত্য অজানা কারণে চাকরিটাও ছেড়ে দিলো। আমার নিজের শরীরেও একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। পরে মেডিকেল টেস্ট এর মাধ্যমে জানতে পারলাম যে আমার শরীরে আদিত্যের ভ্রুণ বাসা বেঁধেছে। আমি আদিত্যকে ফোনে জানালাম।
আমি: আমি কি করবো এখন?
আদিত্য: তুমি কি করবা মানে? Abortion করে নাও।
আমি: আমাকে বিয়ে করে আমার সন্তানের পরিচয়ের স্বীকৃতি দাও। আমাকে গ্রহণ করো।
আদিত্য: অসম্ভব।
আর কোনো কথা না বাড়িয়েই ফোনের লাইনটা কেটে দিলাম। সেই কষ্টের অনুভূতিগুলো কারও সাথে শেয়ার করতে পারি নি। আমি ভ্রুণ হত্যা করতে চাই নি। যে ভালবাসা আমি আদিত্যকে দিয়েছি; সেটা তো মিথ্যা নয়। আমি নিজেও চাকরি ছেড়ে ঢাকা শহরকে বিদায় জানিয়ে রাজশাহী চলে গিয়েছিলাম। আমি আমার চাকরির কিছু জমানো টাকাকে পুঁজি করে দূর সম্পর্কের এক বোনের বাসায় সাবলেটে উঠেছিলাম। এর মধ্যে জানতে পেরেছিলাম আদিত্যের আসল চেহারা। বিভিন্ন মেয়েদের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে উঠতো। যৌন ক্ষুধায় জর্জরিত ছিলো আদিত্য। বিভিন্ন নারীর শরীরে প্রেম খুঁজে বেড়ানো ভদ্রবেশী আরেক পুরুষের নামই হলো আদিত্য। বুঝতে বাকি ছিলো না, এরকম অসংখ্য আদিত্যের ভীড়ে সুপুরুষ ভাগ্যে জোটানো বড্ড কঠিন। আদিত্যরা কেবল নিতেই জানে, দিতে জানে না কিছুই। আর আমাদের মতো তৃষ্ণারা আদিত্যদের খেলার পুতুল হয়ে থাকি কিছুদিন। তারপর আদিত্যরা অন্য পুতুল নিয়ে খেলা করে। আদিত্যরা হাঁস হয়েই জন্মায় এই পৃথিবীতে। অপকর্ম করে পুকুর থেকে উঠে গা ঝাড়া দিয়ে সব জলগুলো ঝরিয়ে ফেলে হাঁসগুলোর মতো। অথচ তৃষ্ণাদের একটু নিজেদের মতো করে বাঁচবার অধিকার নেই। সমাজে তৃষ্ণারা নিগৃহীত, নিপীড়িত। আমাদের বাস্তব গল্প শোনার মতো মানুষ নেই এই সমাজে।
আমার ছেলে অহর্নিশ এর মধ্যে বড় হয়ে গেছে। আজই প্রথম স্কুলে যাবে। ছেলে জানে, তার বাবা সুইজারল্যান্ডে বড় একটি চাকরি করে। কোনো একদিন হয়তো বলতে হবে, “তোমার বাবা বেঁচে নেই। সবার বাবারা বেঁচে থাকে না।” ছেলেটা হয়তো তার বন্ধুদের দেখে মাঝে মাঝে মন খারাপ করবে। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য একটা অবলম্বন দরকার। আর সেই অবলম্বন আমার এই সন্তানের মাঝেই পেয়েছি। এর মধ্যে সন্তান আমেরিকা থেকে মাইক্রোবায়োলজি থেকে পিইচডি করে এসেছে। দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কথা হচ্ছে। কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করবে হয়তো। বয়সটাও বেড়ে গেছে। সহজে কিছুই আর মনে থাকে না। ভুলে যাই সবকিছু। কিন্তু আদিত্যকে শেষ দেখে যেতে পারবো কি না জানি না। খুব জানতে ইচ্ছা করে-“ওর কি একবারও মনে হয় আমার কথা? ও তো জানতেও পারে নি যে ওর সন্তান আছে। ও জানলে ওর প্রতিক্রিয়া কি হবে?” এসব ভেবে ভেবে আমার দিন যায়, রাত যায়………